Wednesday 16 May 2012

আমার রাশিফল -----------

অন্যান্য যেকোনো যুক্তিবাদীর মতো হাত দেখানো, কোষ্ঠীবিচারযাবতীয় বিষয় সম্পর্কে বাইরে আমি প্রভূত অনুকম্পা এবং উপেক্ষা দেখিয়ে থাকি। লক্ষ কোটি মাইল দূরে থেকে আকাশের গ্রহ-নক্ষত্রেরা কোনো এক জৈব-কণিকা সুনন্দ রায়ের ভাগ্যনিয়ন্ত্রণ করে আসছে, রকম একটা উদ্ভট কল্পনাকে প্রশ্রয় দিতে যাব এই যুগে? তবু একেবারে উচ্চ উচ্চ শিক্ষিতমানে, পিআরএস, পিএইচডি, ডিএসসি ইত্যাদি উপাধিওলা অতীব জ্ঞানী ব্যক্তিদের আসরেও কখনো কখনো প্রয়োজনের তাগিদে আমাকে বসতে হয়। তাঁরা তুচ্ছ মাছের দর, বাংলা ফিল্মএসব থেকে শুরু করে বিশ্বের বিবিধ জ্ঞানের জগতে উত্তীর্ণ হয়, আমি মুগ্ধ কাকের মতো হাঁ করে সেই আলোচনাগুলো শুনে থাকি। এরই মধ্যে হঠাত্ অঘটন ঘটে। হয়তো কোনো এক বিদেশি পিএইচডিজগতের সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক পরিচয় যাঁর নখদর্পণেতিনিই হঠাত্ আরেকজনের হাত টেনে নিয়ে দেখতে শুরু করেন। তারপরই বিশ্বজ্ঞান সাময়িকভাবে স্থগিতওই ভদ্রলোককে ঘিরে প্রসারিত হস্তের অরণ্য? আমিও তার ভেতরে হাতটা গুঁজে দেওয়ার চেষ্টা করি। আর সমবেতভাবে মুখে ফুটিয়ে রাখি একটা সকৌতুক হাসির রেখাভাবটা: ‘সবই তো বাজে, তবু মজাটা দেখাই যাক না একবার!’ কিন্তু মনের অগোচর তো পাপ নেই। যেকোনো বাঙালি মধ্যবিত্তের মতো জীবনযুদ্ধে যতই বিধ্বস্ত হয়ে যাচ্ছি, ভবিষ্যত্টা যতই অতীতে পর্যবসিত হচ্ছে, ততই নিজের ভাগ্যফল জানার জন্য আকুল হয়ে উঠছি। আমার জন্মকালে, যেকোনো বিশ্বাসী হিন্দু- পরিবারের মতো আমারও একটি রাশিচক্র তৈরি হয়েছিল শুনেছি। কিন্তু পাকিস্তানের বাড়ির সঙ্গে সঙ্গে সেটিও অবলুপ্তসুতরাং গ্রহ-নক্ষত্রেরা আমার জন্য কোন ভাগ্য তৈরি করে দিয়েছিল, তা আর জানার উপায় নেই। শুনেছি, জন্মদিন থেকে রাশিচক্র তৈরি করে দেন জ্যোতিষীরা, কিন্তু আমার আর সাহসে কুলোয় নাকেঁচো খুঁড়তে গিয়ে কোন কেউটে সাপ বেরিয়ে আসবে কে জানে। অতএব রবিবারের বাংলা খবরের কাগজ খুলে আমার প্রথম দ্রষ্টব্য: ‘রাশিফল 
কিন্তু সমস্যা হলো, আমার কোন রাশি? মেষ, বৃষ, মিথুন থেকে কুম্ভ, মীন পর্যন্ত সবগুলো অনুধাবন করলুম। বৃষ? উহুঁহুনা মিলছে চেহারায়না শৃঙ্গধারী পৌরুষে। মিথুন? কিসের মিথুন? গৃহিণী সপ্তাহে চার দিন করে জানাচ্ছে যে পৃথিবীর সবচেয়ে অপদার্থ লোকটির পাল্লায় পড়েছে সে। কর্কট? আরে ছ্যা
বৃশ্চিক? নেভার। সিংহ? বাপরে রকম শৌর্যবীর্য কোথায়? ধনু? তা ওই রকমই বেঁকে আছি বটেকিন্তু তীরটির ছুঁড়তে পারি না। কন্যা? অসম্ভবস্ত্রীজাতি হতে চাই না। তুলা? শেষে দাঁড়িপাল্লা হব? ইমপসিবল। মকরমানে কুমীর? নাআমি কারুর ঠ্যাং ধরে তলিয়ে নিতে চাই না। কুম্ভ? ওই রকম হয়ে বসে আছি বটেকিন্তু কলসি হতে কে চায়আর যখন ওতে করে নিজের চেহারার ওপরে রিফ্লেকশন আসে! মীন? আরে রাখোমাছ হতে যাব কোন দুঃখে? বিশেষ করে ইংরেজিমীন’-এর একটা বাজে অর্থ আছে যখন। সুতরাংবাই অভ এলিমেনেশনমেষটাই পছন্দ করা যাক। বেশ নিরীহ, শান্ত একটি বঙ্গীয় মেষশাবক। লড়াইয়ে মেড়া নয়-রকম দুর্ধর্ষ গোঁ আমার নেইআমি ইংরেজি নার্সারি রাইমেরমেরি হ্যাড লিটল ল্যাম্ব’-এর সেই ভেড়ার শিশুটি। দ্বিজেন্দ্রলালের জ্বলন্ত ধিক্কার আমাকে লজ্জা দেয় না: ‘মানুষ আমরা, নহি তো মেষ।আমি বরংআমরা পরের কমাটাকেনহি তো পাশে তুলে এনেআমার দিক থেকেই, আত্মপক্ষ সমর্থন করতে চাই: ‘মানুষ আমরা নহি তো, মেষ।অতএব আমার রাশি আমি আবিষ্কার করেছি। বেশ ছিলুমপ্রত্যেক রবিবারে রাশিফল দেখে যাচ্ছিলুম বাড়ির বাংলা কাগজটিতে।ব্যয়াধিক্যে কষ্ট পাবেন, কর্মক্ষেত্রে পরিবর্তন দেখা যায় না, শত্রুতা বৃদ্ধি হতে পারে, শেষের দিকে আর্থিক উন্নতি হবে—’ ইত্যাদি দেখে কখনো পুলকিত, কখনো রোমহর্ষিত, কখনো বিচলিত, কখনো বিমোহিত, কখনো ভাবিতএইসব হওয়া যাচ্ছিল। মিলুক আর না- মিলুক—‘অপ্রত্যাশিত অর্থলাভ করবেন, শত্রুরা পরাভূত হবে, কর্মক্ষেত্রে যশোলাভ করবেন’— রকম কোনো মোক্ষম ঘোষণার জন্য ব্যাকুল হূদয়ে অপেক্ষা করে আছিএমন সময় আরেকটা গোলমেলে ব্যাপার হয়ে গেল। রবিবার সকালে এক ভাইপো দেখা করতে এসেছিল, তার হাতে ছিল সেদিনের কাগজ। যাওয়ার সময় ভুল করে ফেলে গেল। আমি কাগজটা রাখি নাখুলে, এররাশিফলদেখে তো আমার চক্ষুস্থির। ইতিপূর্বে আমার কাগজটিতে মেষ সম্পর্কে জেনেছি: স্বাস্থ্য ভালো যাবে, আয়ব্যয়ের সমতা থাকবে, ব্যবসায়ীর পক্ষে মোটামুটি শুভকিন্তু যে দেখছি একেবারে উল্টো গাইছে! ‘ব্যয়বৃদ্ধিতে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হইবেন, শরীর ভালো যাইবে নানতুন প্রচেষ্টায় অগ্রসর হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়।একি ব্যাপার! মনে একটা জটিল দুর্ভাবনার উদয় হলো। প্রতিবেশীর কাছ থেকে তৃতীয় আরও একটা কাগজ আনালুম। এবং যা দেখলুমতা না বলাই ভালো। মোটের ওপর, সেখানেও ভাগ্যাচার্য আরেকটি তৃতীয় মত পোষণ করছেন। এঁরা সবাই তো গুণীব্যক্তিকিন্তু আমি কোন দিকে যাই? কিছুক্ষণ চোখ বুজে বসে থাকা গেল। তারপর পরশুরামেরভুশণ্ডীর মাঠে কারিয়া পিরেতের মতো দরাজ গলায় গেয়ে উঠতে ইচ্ছে করল: ‘আরে ভজুয়াকে বহিনিয়া ভগলুকে বিটিয়া/কেকরাসে সাদিয়া হো কেকরাসে হো--—’! মানেআমারসাদিয়া’—কোন কাগজেররাশিফলে সঙ্গে? হঠাত্ একটা জিঘাংসা জাগল। চুলোয় যাক মেষ! আমি তোফ্রি লানস’—যদি জুত্সই একটা ভালো গণনা পেয়ে যাইযেকোনো রাশি হতে আপত্তি নেই। বৃষ-বৃশ্চিক-কর্কশ-কন্যা-মকর-মীনঅ্যানিথিং। দেখা যাকএঁরা তিনজন কোন রাশি সম্পর্কে একমত। সেইটেই আমার রাশিন্যায়তঃ ধর্মতঃ হতে বাধ্য। এক ঘণ্টা স্ক্রুটিনি বৃথাই গেল। আলাদা কাগজের পাঠকের আলাদা রাশিফল হয় কি না কে জানে! ঠিক আছে, আমি মরিয়া। প্রত্যেক সপ্তাহে রাশি বদলাব এরপর থেকে। যেকোনো রাশিতে বিহার করে বেড়াব আর যেটা সবচেয়ে খারাপসেইটেই বেছে নেব। নিজের জন্য এসপার-ওসপার হয়ে যাক একটা

নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় (১৯১৮-১৯৭০
: কথাসাহিত্যিক। এই রচনাটি তাঁরসুনন্দর জার্নালথেকে সংগৃহীত


No comments:

Post a Comment